বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসার ইতিহাস,

 
কওমি মাদ্রাসা,
শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান দুই প্রকারঃ
· জাগতিক শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানঃ যে সকল প্রতিষ্ঠান দুনিয়ার কল্যানের জন্য ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়।
· ইসলামী  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ যে সকল প্রতিষ্ঠান আখেরাত অর্থাৎ পরকালের কল্যানের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়।
বাংলাদেশ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুই প্রকারঃ
· আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা   প্রতিষ্ঠানঃ যা সরকারীভাবে খরচ ও নিয়ন্ত্রণে চলে। যাহাতে পুরাপুরি দ্বীনি ইলম শিক্ষা ব্যবস্থা নাই।
· কওমী মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ যা জনগণের সাহায্য সহযোগিতায়, হক্কানী ওলামায়েকেরাম দ্বারা, দারুল উলম দেওবন্দ (ভারত)-এর শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ ও অনুকরণ করে পরিপূর্ণ দ্বীনি ইলম শিক্ষা ব্যবস্থা আছে।
উপরোক্ত প্রসঙ্গে নিম্নে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হইলঃ
কওমী মাদ্‌রাসা অর্থ কি?
কওম অর্থ জাতি, আর কওমী অর্থ জাতীয়। মাদ্‌রাসা আরবী শব্দের অর্থ বিদ্যালয়। সুতরাং কওমী মাদ্‌রাসা অর্থ জাতীয় বিদ্যালয়।

কওমী মাদ্‌রাসা শিক্ষার উৎস্?
হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন পবিত্র মক্কা নগরীস্থ নূর পর্বতের গুহায় মানবজাতির কল্যাণে প্রভুর সান্নিধ্যে ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তখন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা জিবরাইল (আ·) এর মাধ্যমে ইকরাপড়ুন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, আপনার প্রতিপালক অতি মহান (সূরা আলাক ১-৪) এ জ্ঞানের সূচনা করেন। অতপর মক্কা মুকার্‌রমার দ্বারে আকরামে, মদীনা মুনাওয়ারায়।

কওমী মাদ্‌রাসার মৌলিক উদ্দেশ্যঃ
কওমী মাদ্‌রাসার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন-হাদীসের প্রচার-প্রসার এবং দ্বীন ইসলামকে বিশুদ্ধরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা এবং দ্বীনের শাশ্বত শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। ইসলামী শিক্ষার সুরক্ষার সাথে সাথে নিত্যনতুন সৃষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, ফেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে মুসলিমজাতিকে সতর্ক করা, তাদের হিংস্র থাবা হতে মুসলিমজাতিকে রক্ষা করা।

কওমী মাদ্‌রাসার বৈশিষ্ট্যঃ
কওমী মাদ্‌রাসা ছাত্রদেরকে কুরআন-হাদীসের আলোকে জ্ঞান দান করে, ত্যাগী, পরোপকারী, সমাজসেবক, অধিক ভোগ-বিলাসে নিরুৎসাহী এবং স্বল্প উপার্জনে সন্তুষ্ট থেকে জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। এখানে দুনিয়া বিমুখতা, কষ্ট, সবর, শোকর, আত্মীয়তার বন্ধন, ন্যায়পরায়ণতা, মমত্ববোধ, উত্তম আখলাক-চরিত্রের বিষয়গুলোই শিক্ষা দেওয়া হয়। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, ভূমি দখল, হল দখল, দুর্নীতি, মিথ্যা, প্রতারণা, ব্যাভিচার, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা, অপকর্ম, চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবী, অপসংস্ড়্গৃতি ইত্যাদির সাথে কোন রকমের সম্পর্ক রাখে না। এমনকি থানাগুলোতেও সন্ত্রাসীদের তালিকায় কোন কওমী মাদ্‌রাসার শিক্ষক বা ছাত্রদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলে না। খাঁটি মানুষ তৈরির কারখানাই হল কওমী মাদ্‌রাসা।

কওমী মাদ্‌রাসার প্রয়োজনীয়তাঃ

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা জাতির উন্নতির সোপান। শিক্ষা জাতিকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে পথ নির্দেশ করে। শিক্ষা মানুষকে সুন্দর, পরিমার্জিত ও আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে মানবরচিত পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা কখনো মানবজীবনের সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত কুরআন ও নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত সফলতা ও কামিয়াবী বয়ে আনতে পারে। এ জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর অত্যাবশ্যকীয় ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা ফরজ করে দিয়েছেন। এছাড়াও ইসলামী শিক্ষা হচ্ছে শাশ্বত শিক্ষা। এ শিক্ষাই মানুষকে নৈতিকতার উচ্চাসনে সমাসীন করতে পারে। আর কওমী মাদ্‌রাসা হচ্ছে এই ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ও সত্যিকার ধারক-বাহক। এজন্য কওমী মাদ্‌রাসা হতে শিক্ষাপ্রাপ্তরা সমগ্র দুনিয়াতে ইসলাম ও মানবতার খিদমতে নিয়োজিত। দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামী মূল্যবোধের হেফাজতের লক্ষ্যে তাঁরা খোদায়ী মদদে বুকটান করে এগিয়ে আসেন। তবে হঁ্যা জাগতিক জীবন পরিচালনার জন্য সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখযোগ্য, আর এজন্য কওমী মাদ্‌রাসাও এ ধরণের দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হতে কুরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান অর্জন করে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন হাদীসের বিধি-নিষেধ মোতাবেক জীবনযাত্রা পরিচালনা করা একান্ত কর্তব্য। আর তাই একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়েছে যে, কওমী মাদ্‌রাসা ও কওমী মাদ্‌ারাসাভিত্তিক সঠিক ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

কওমী মাদ্‌রাসার অবদানঃ
কওমী মাদ্‌রাসা সিরাতে মুস্তাকীমতথা সরল সঠিক পথের সংরক্ষক ও প্রহরী; যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সাহাবায়েকেরাম, সাহাবায়েকেরাম হতে তাবিঈন, তাবিঈন হতে তাবে তাবিঈন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীন পর্যন্ত পৌঁছেছে। অতঃপর আইম্মায়ে মুজতাহিদীন হতে প্রত্যেক যুগেই এ আমানত উম্মতের নির্বাচিত শ্রদ্ধেয় মনীষীগণের মাধ্যমে পৌঁছেছে, নিঃসন্দেহে তা সামষ্টিকভাবে অক্ষত। এইভাবে দ্বীনের স্থায়ী সংরক্ষণ হয়ে আসছে। আল্লাহ তাআলা কওমী আলেম-ওলামা দ্বারা বিগত দিনগুলোতে দেশ-জাতি ও দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন- তা      দৃষ্টান্তহীন। হেদায়াতের এমন কোন পথ নেই, যাতে কওমী আলেম দ্বারা পথনির্দেশিকা স্থাপন করা হয়নি। বিশ্ব পরিস্থিতিতে দ্বীনের অপব্যাখ্যা, অপপ্রচার সম্পর্কে মুসলিমজাতিকে সচেতন করে তোলেন কওমী ওলামায়েকেরাম। তারা ধর্মহীনতা, বদদ্বীনি, নাস্তিকতার প্লাবনে ভেসে যাওয়া মুসলমানদের পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। তাঁরা বর্তমান সময়ে ইসলাম এবং মুসলিমজাতির হেফাযতের গুরু দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরাম হাদিস, ফেকাহ তাফসীরসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের সহায়ক বহু গ্রন্থ রচনা করছেন। এর পাশাপাশি যারা তাফসীরের নামে পবিত্র কুরআনের অপব্যাখ্যা, বিকৃত ব্যাখ্যা করে, তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন। মুসলিম উম্মাহকে এ সম্পর্কে সচেতন করেন। আমাদের দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাঁদের আদর্শ লালন করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ওলামায়েকেরামের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। হিংস্র ইংরেজ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জিহাদের ফতোয়া প্রদান করেন ওলামায়েকেরাম। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্বেও ছিলেন ওলামায়েকেরাম। কওমী ওলামায়েকেরামের কর্ম তৎপরতার কেবলমাত্র শিক্ষা-সংস্ড়্গৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম উম্মাহর মাঝে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সুস্থ       চিন্তাধারার বিকাশ, দ্বীনের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ময়দানে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হয় কওমী মাদ্‌রাসার স্বর্ণ সন্তানদের মাধ্যমে। কওমী মাদ্‌রাসা ও তার স্বর্ণ সন্তানদের অবদানের মৌলিক দিকগুলো হচ্ছে-
১। ইসলামী শিক্ষা বিকাশে কওমী ওলামায়ে কেরামের বলিষ্ঠ ভূমিকা।
২। ইসলামী তাহযীব-তমাদ্দুন সংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণকল্পে আত্মনিয়োগ।
৩। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় কওমী ওলামায়ে কেরামের অবদান।
৪। বিদআত-কুসংস্ড়্গার মোকাবেলায় ওলামায়ে কেরামের অবদান।
৫। ইসলামের প্রচার-প্রসার, ওয়াজ নসীহত এবং দাওয়াত ও তাবলীগ, গ্রন্থ সংকলন ও গ্রন্থ রচনা করা।
৬। রাজনৈতিক ময়দানে ইসলামী রাজনীতি বাস্তবায়ন।
৭। তাসাউফ তথা মানবিক আত্মশুদ্ধির ময়দানে কার্যকরী দিক-নির্দেশনা প্রদান।
৮। বিভিন্ন বাতেল ফেরকা বিরোধী কার্যকরী ভূমিকা জোরদার ও আন্দোলনে কওমী ওলামায়ে কেরামের অবদান।
৯। দুনিয়াবী সফলতার সাথে সাথে আখেরাতের মহাসফলতার সঠিক পথ প্রদর্শন।